কবি কোন পক্ষ নেয় এবং তাঁর কবিতার বক্তব্য কবিকে স্মরণীয় করে
- মাক্সামড যশি ধামাক ‘গেরি’
ভাষান্তর-গাজী সাইফুল ইসলাম
|
Maxamed Xaashi Dhamac 'Gaariye |
মাক্সামড যশি ধামাক ‘গেরি’ (Maxamed
Xaashi Dhamac ‘Gaarriye) ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে সোমালিয়ার হারগেসায় জন্মগ্রহণ করেন।
সমপ্রতি তিনি দি পোয়েট্টি ট্রান্সলেশন সেন্টর’স ওয়ার্ল্ড পোয়েটস’ এর সঙ্গে যুক্ত হন এবং যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করেন। ওলফ ট্রান্সলেশন
ফিচার এর ১২তম ইস্যুতে গেরির কবিতা কর্মের ওপর আলোকপাত করা হয়। ১৯৭০-এর পর থেকে (বর্তমান
পর্যন্ত) গেরি সোমালিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীবিত কবি। লিখেও যাচ্ছেন বহুবিদ
বিষয়ে। পরমাণু অস্ত্র থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা সবই তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু। উল্লেখ্য যে,
সোমালিয়ায় ম্যাক্সামড শব্দটা দ্বারা মুহাম্মদকেই বুঝিয়ে থাকে।
প্রশ্ন : আপনি সমপ্রতি দি পোয়েট্টি ট্রান্সলেশন সেন্টর’স ওয়ার্ল্ড পোয়েটস’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্যে বেড়াতে এসেছেন।
ইংল্যান্ড ভ্রমণ করে এবং এখানকার দর্শকদের সামনে কবিতা পড়ে কেমন লাগছে আপনার?
উত্তর : এ অর্থে ভালোই লাগছে
যে, আমার কবিতা আন্তর্জাতিকভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, যা আসলে প্রয়োজনও। এটাও সত্য
যে, এই প্রথমবার আমার কবিতা ইংরেজি ভাষাভাষীরা শোনার সুযোগ পাচ্ছে এবং সম্ভবত কোনো
সোমালি কবির কবিতাও এই প্রথম, যা খুবই অর্থবহ।
প্রশ্ন : আপনার কবিতার অনুবাদ করেছেন এ সময়ের আমাদের সবচয়ে ভালো একজন কবি ডেভিড
হারসেন্ট, যিনি মার্টিন অরউইন ও অ্যালটরস্কোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করেন। ইংরেজিতে তার রয়েছে
দারুণ দখল। তার অনুবাদ আপনার কেমন লেগেছে?
উত্তর : অনুবাদে ডেভিট হারসেন্টের
অনেক কাজ। এই ভ্রমণে তার সঙ্গে কবিতা পড়ার সুযোগ পেয়ে আমি খুশি। তিনি আমার কবিতার মূলভাব
ধরে অনুবাদ করতে পেরেছেন, যা প্রথম অনুবাদে প্রায়শই হারিয়ে যায়।
প্রশ্ন : সোমালিয়ায় কবিতার গুরুত্ব বেড়েছে যেহেতু সেই ১৯৭০-এর দশক থেকে হাদরাবি
ও আপনার মতো কবির আবির্ভাব ঘটেছে। আচ্ছা, সোমালিয়া কি তার কাব্যিক ঐতিহ্য
থেকে সরে যাচ্ছে, অথবা নাকি বাচনিক (লোকো) সাহিত্যে কবিতার
চিরকালীন গুরুত্বই কমতে শুরু করেছে?
উত্তর : এ কথা ঠিক আবার ঠিকও
না। সোমালিয়া তার মুখে মুখে রক্ষিত অনেক ঐতিহ্যই হারাচ্ছে না। যদিও সোমালিয়ো ভাষা
প্রথমবারের মতো সঠিকভাবে ১৯৭২ সালে লিখত হয় কিন্তু তথাপি এটি একটি অধিকমাত্রায় মৌখিক
বা (বাচনিক) ভাষা। এখানো ওখানে কোনো অভিধান নেই। অতীতে সোমালিয়ায় বেশিরভাগ কবিতা রচিত
হতো মুখেমুখে, যদিও ওখানকার লোকেরা কমিউনিটি জুড়ে কবিতা আবৃতি করে, ক্যাসেটে ধারণ করে। প্রযুক্তির
কিছু উন্নতি সত্ত্বেও আমি যখন থেকে লিখছি, যথেষ্ট দৃষ্টিকটুভাবে সবকিছুতে পরিবর্তন
ঘটছে আমার মনে হয় না। তবে সম্ভবত চাপ রয়েছে সময়কে লেখার মাধ্যমে কাজে লাগানোর জন্য।
এতে খুব বেশি না হলেও কিছু কাজ হচ্ছে। কিছু টাকাও আসছে। আর টাকা নিশ্চন্তভাবে ভেতর থেকে লেখায়ও ইন্ধন যোগাচ্ছে।
আমি নিজেও এতে যাপন করছি অধিকতর স্বস্তির জীবন।
প্রশ্ন
: সোমালিয়ায় কবিতা পড়ার বিষয়টা বেশ জনপ্রিয়। আঞ্চলিক জনপদ থেকে শহর পর্যন্ত শত-সহস্র
লোক চলে আসে কবিতা শোনার জন্য। কমসংখ্যক লোকের উপস্থিতিতে কোনো স্থান যেমন ইল্কলি ও
কারডিপ-এ কবিতা পড়ার সঙ্গে এর কীভাবে তুলনা হতে পারে?
উত্তর : এ দু’য়ের অভিজ্ঞতা
সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইল্কলিতে যারা কবিতা শুনতে আসে তারা সোমালিয়ার বাসিন্দাদের চেয়ে অধিকমাত্রায়
ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত। আমার নিজস্ব লোকদের সামনে কবিতা পড়া-তারা সংখ্যায় যত বেশিই
হোক আমার কাছে নতুন কিছু না। কিন্তু লন্ডনের ব্রুনাই গ্যালারিতে ১০০ এর বেশি সোমালি
উপস্থিত হওয়ায় আমি চমৎকৃত হয়েছি। হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন, অনেকবেশি লোকের উপস্থিতিতে সোমালিয়ায়
আমি কবিতা পড়ি। অনেক বেশি দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতির কারণে নিজের সম্পর্কে বিস্তৃত ব্যাখ্যাটা আমার জন্য সহজ হয়ে যায়।
প্রশ্ন
: এখানে এসে ইংরেজি কবিতা সম্পর্কে আপনার কেমন ধারণা হলো?
উত্তর : এখানে পৌঁছে আমি যা
আবিস্কার করেছি, আপনি যদি ইংরেজি ও সোমালি কবিতার কথা ধরেন, তাহলে
বড়রকম পার্থক্যটা হবে কবিদের কাছে প্রত্যাশার বিষয়টা। দু’য়ের পার্থক্য
হলো দায়-দায়িত্বের। সোমালিয়ার একজন কবি হিসেবে আমার কাছে লোকেদের প্রত্যাশার স্তরটা
অনেক উঁচু এবং কবি হিসেবে তাদের প্রতি আমারও রয়েছে বিশাল দায়িত্ব। কিন্তু ইংল্যান্ডে
মনে হয় কবির কাছে প্রত্যাশা খুবই সামান্য। ইংরেজ কবিরা কবিতা লিখেন তাদের লোকেদের জন্য
নয়-নিজেদের জন্য। এ জন্যই হতে পারে ইংরেজি কবিতার প্রতি অনেক লোকের আর আগ্রহ নেই। এটা
অবশ্য একান্তই আমার অভিমত। কিন্তু সোমালিয়ায় আমার কোনো সুযোগ নেই, উদাহরণস্বরূপ ধরুন, একটি বোতল অথবা একটি ফুল নিয়ে কবিতা লেখার। যদি সোমালিয়ায় আমি এরকম হাজারটা বিষয়ে
কবিতা পড়তে দাঁড়াই, কেউই বুঝবে না কবিতায় কেন এমন বিষয় নিয়ে আমি কথা বলছি। কেউ
গুরুত্ব দেবে না। যাহোক, ইংরেজি কবিতা আমি পড়েছি এবং বুঝতে পেরেছি ইংল্যান্ডের সাহিত্য
ও সংস্কৃতিতে এগুলো ভালো কবিতা। কিন্তু সমস্যাটা তখনই হবে, যখন এগুলো সোমালি ভাষায় অনূদিত
হবে। এসব কবিতার বক্তব্য সোমালিদের কাছে খুব
বেশি বোধগম্য হবে না।
প্রশ্ন
: আপনি আগে আমার কাছে বলেছেন, কাট চিবানো (chewing Qat) আপনার
সৃজনশীল শক্তিকে চূড়ান্তভাবে শক্তিকৃত করে। সোমালিয়া জুড়ে কবিদের কাছে কাট কি পছন্দের
ড্রাগ?
উত্তর : কারও কারও জন্য একগ্লাস মদ বা
ভালো খাবার লাগে। কিন্তু আমার কাট হলেই চলে। ওটা আমাকে সেই লাথি দেয়-যা আমার প্রয়োজন।
ওটা গ্রহণ না করে আমি কোনো কবিতা লিখিনি। আমি নিশ্চন্ত নই সৃষ্টিশীল কাজ করার জন্য
অন্য লোকেরা এটা ব্যবহার করে কিনা। এ ব্যাপারে আমি শুধু আমার নিজের কথা বলতে পারি।
প্রশ্ন
: কবি হিসেবে আপনার শিক্ষা গ্রহণকালে আপনি কি পশ্চিমা কবিতার সংস্পর্শ পেয়েছিলেন?
উত্তর : সত্য বলতে খুব না। কিছু
শেকসপিয়ার ও কীটস। টিএস ইলিয়ট পড়েছি সামপ্রতিককালে। স্বতস্ফূর্তভাবে প্রধানত পেয়েছি আরবি সাহিত্য, আমাদের দেশের নিকট সম্পর্কিত
ভাষা হিসেবে এতে প্রবেশ করা আমাদের জন্য সহজ ছিল। আরব বিশ্বের কবিতায় এমন সম্পদ আগেও
ছিল এবং সবসময় নতুন নতুন কবিদের আবির্ভাব ঘটছে। সব কবিদের কবিতা সংগ্রহ করা এবং পড়াটা
কঠিন। তবে শেকসপিয়ারের কিছু নাটকের প্রভাব আমার ওপর রয়েছে। আমার মনে পড়ে, হারগেসার স্কুলে হ্যামলেট নাটকে আমি অভিনয় করেছিলাম ।
প্রশ্ন
: সোমালিরা নিঃসন্দেহে প্রকৃত রসপণ্ডিতের পরিচয় দেয়-যখন তাদের নিজেদের কবি সম্পর্কে
জানার প্রসঙ্গটি ওঠে। দেশটির প্রধান কবি আপনি। এই বিষয়টা কি আপনাকে আরও জরুরিভাবে লোকদের কণ্ঠস্বর হিসেবে ভূমিকা রাখার দিকে নিয়ে যাচ্ছে ?
উত্তর : এর চেয়েও বড় কথা যে, এটা আমাকে মানুষ হিসেবে বিশেষভাবে দায়িত্ববান করে তুলে। হারগেসায় আমি আমার পছন্দমতো
আচরণ করতে পারি না। তাছাড়া আমার চারপাশে সবসময় সেইসব লোকদের ভিড়ে লেগেই থাকে-যারা আমাকে
অনুকরণীয় মনে করে। তাই আমাকে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আচরণ করতে হয়। আমাকে কথাও বলতে
হয় ভেবেচিন্তে, কারণ সোমালি লোকেরা কী বলি তা শুনতে চায়। আমি প্রকাশ্যে পান করি না কিংবা ড্রাগ
নিই না। এতে লোকেরা ভুল বুঝতে পারে। আপনার ভাষায় এটা হয়তো ‘তারকা
অবস্থান’ হিসেবে বর্ণিত হবে।
প্রশ্ন : সোমালিদের মুখে শুনেছি- কবিরা সেখানে কিছুটা সম্মান পেয়ে থাকে-এই যা।
ওটা কি কোনো বাওতাবাজির জায়গা?
উত্তর : হ্যাঁ, লোকেরা সহজেই তাদের চিনে ফেলে।
প্রশ্ন
: কোন জিনিস কবিতাকে স্মরণীয় করে?
উত্তর : কবি কোন পক্ষ নেয় এবং তাঁর কবিতার
বক্তব্য।
প্রশ্ন
: নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে আপনার রয়েছে দীর্ঘ কবিতা (তাঁর ৬০তম জন্মদিনে লেখা), যা ম্যান্ডেলাকে
অতিক্রম করে গিয়েছে বহুদূর এবং এটি পরিণত হয়েছে একটি মানবিক মন্তব্যে। আপনার কবিতার
মধ্য দিয়ে যেন ম্যান্ডেলা কথা বলেছেন। ওটা কি ছিল উদ্দেশ্য প্রণোদিত?
উত্তর : হ্যাঁ, আমি তার মধ্য দিয়ে এবং তিনি
আমার মধ্য দিয়ে কথা বলেছেন। কবিতাটা মাথায় এমনি এমনি এসেছিল, বড় কোনো পরিকল্পনা ছিল না। সত্যি
এভাবে (এধাচে) কবিতা আমি লিখি না। কিন্তু ম্যান্ডেলার মধ্য দিয়ে আমি অনেক বিষয়ে বলতে
চেয়েছিলাম-যা আমাদের মানবতাকে প্রভাবিত করে। রাজনৈতিক বিষয়াবলী নিয়েও আমি বলতে চেয়েছিলাম, যা মনে হয়েছিল আমার নিজের দেশের বাস্তবতার আলোকে।
প্রশ্ন : এখানে আপনার কবিতা পড়ার সংবাদ বুনো আগুনের মতো সোমালিরা কমিউনিটিতে ছড়িয়ে
পড়েছে। যারা এখানে নির্বাসনে আছেন তাদের অনেকেই আপনাকে পড়তে দেখছেন, অনেকেই
আবার দেখছেন না। আপনার দেশের অনেক অনেক লোক, যারা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জন্য কঠিন যুদ্ধ করছেন, তাদের সামনে কবিতা পড়াটা আপনার কাছে কতটুকু
গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর : এটা আমার জন্য সত্যি
বিশেষকিছু। দেখতেই পাচ্ছেন কত সোমালি আমার কবিতা শোনার জন্য এখানে এসে ভিড় করছেন।
তাদের আগমনে পড়ায় আমি উদ্দীপিত হয়েছি। তাদের নিজেদের একজন কবিকে এখানে পেয়ে তারা যে
কতটা খুশি আমি তাদের চোখেমুখে দেখেছি। এছাড়াও বিশ্ব কবিদের এ ভ্রমণে অংশ গ্রহণ করে
আমি সবকিছু উপভোগ করেছি। অবিস্মরণীয় এ স্মৃতি নিয়ে আমি ঘরে ফিরে যাব।
প্রশ্ন : লন্ডন কি আপনাকে অনুপ্রাণিত করে ? ভ্রমণ অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত
হওয়ার জন্য কোনো কবিতা কি পথে উঠে এসেছে?
উত্তর : এখানে থাকা অবস্থায়
আমি কবিতা লিখতে পারিনি। তবে এ ভ্রমণস্মৃতি অবশ্যই আমার মনে রয়ে যাবে। লন্ডন বিশ্বের
শহর। এটা একটা বিশেষ জায়গা।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ- জেমস বার্ন
(Interviewed by-James
Byrne)
ম্যান্ডেলা (Mandela)
ম্যাক্সামড যশি ধামাক ‘গেরি’
কবিতাটি আমার হাতের মুঠোয়।
ছবিগুলোও ভিড় করছে আমার মাথায়।
কবিতাতেই সম্ভব
এই গল্পটি সহজে বলা।
কবিতা তার অন্তর্নিহিত শক্তি ও সৌন্দর্য দিয়ে
গল্পকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করে।
যতদিন ধরে ছবিগুলো মাথায় আছে
ততদিন ধরে এই কবিতা লিখে যাচ্ছি আমি।
|
Nelsom Mandela |
নিপীড়ক লোকটি আদালতে আসে
প্রসিকিউটর সে
বিচারক ও জুরিও
কোনো হার-জিত নেই সেখানে,
মামলায় ছেদ পড়ে আর শুকিয়ে তা নির্জলা হয়।
বিবাদী একা দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রসিকিউটর নাম ডাকে
সাক্ষী হিসেবে নিজেই সে বলে-হাজির
বিচারক আইনের প্রতি সমর্থন জানায়
যা তার নিজেরই বানানো।
এর পরিবর্তন, পরিবর্ধ্বন হয়
তারই ইচ্ছেতে।
জুরি শুধু একটি শব্দই জানে,
আর সে শব্দটি হলো ‘দোষী’।
এই কবিতা
হলো একটি বন্দুক।
এই কবিতা
হলো একটি গুপ্তঘাতক।
ছবিগুলোর
জ্বলজ্বলে ভিড় আমার মনে...
এই কলম
একটি বর্শা, একটি ছুরি,
ছেঁকা দেয়ার তপ্ত লোহা, একটি তীর
যৌক্তিক
ক্রোধে সুঁচালো এর অগ্রভাগ ।
যা লিখে
রক্ত আর পলাগ্নি দিয়ে।
এটিতে ভরা হয় রক্তলাল তিক্ততার কালি
এরপর চিহ্নিত করে আমার নাম।
মর্মঘাত
বা জখমের নাম দেয় দুর্নীতি,
বিষাক্তগাছের নাম দেয় প্রাণরস
ঘৃতকুমারি, পিত্ত আর বৃক্ষআঠা যুক্ত করে তাতে।
এই কবিতা একটি ভরা বন্দুক,
এই কবিতা একটি কালাশনিকভ।
আমি এটিকে তাক করি সাপের দিকে
যে সাপ লাফিয়ে এগোয় আমাদের শিশুদের প্রতি
আর দংশন করে! দ্রষ্টব্যযুক্ত গল্পটি কোথায়?
এখানে দেখুন, ত্বকের ওপর রক্তযুক্ত মুক্তোর-জপমালা।
সাপ, প্রসিকিউটর,
নিপীড়ক, বিচারক, জুরি-
তোমার লক্ষ্যস্থল হবে অবশ্যই এদের মাথা ।
এই কবিতা একটি বন্দুক
আর এর শব্দাবলি গোলাবারুদ।
এই কবিতা একটি গল্প শোনায়
কাটাছেঁড়া কিংবা সেন্সর চলে না এ গল্পে।
এই কবিতা নয় বিক্রির জন্য
মানুষ কিংবা পশুর মতো একে যায় না কেনা।
সুতরাং হীনতা পোষণ করবেন না এ সম্পর্কে
ফিরিয়ে নিন আপনার টাকা, আপনার পকেটে
আর শুনে রাখুন
প্রত্যেকেই শুনে রাখুন,
কেউ নয় নিরঙ্কুশ ভালো আর মহান
এমনকি নেলসন ম্যান্ডেলাও।
বিচারক! জুরি, প্রসিকিউটর!
প্রত্যেকেই শুনুন
আসুন পুলিশ ভাইয়েরা, শুনুন!
আসুন কারা পরিদর্শকগণ, শুনুন!
যারা মিথ্যের চাষবাস করেন, শুনুন
যারা নিপীড়ন করে আনন্দ পান, শুনুন!
আমি আপনাদের এ কবিতা শোনাতে চাই
আমি আপনাদের আমার কথা শোনাতে চাই,
ধরে নিন আমিই নেলসন ম্যান্ডেলা
আমি ম্যান্ডেলা বলছি-
একজন ক্রোধান্বিত মানুষ বলছি
যার কণ্ঠ থামিয়ে দেয়া হয়েছে,
যার মুখ সিলগালা করে দেয়া হয়েছে-
কারণ, একবার আমি বলেছিলাম, ‘না!’
‘না!’ প্রসেকিউটরের প্রতি
‘না!’ বিচারক ও জুরির প্রতি,
‘না!’ অবিচারের প্রতি,
‘না!’ অসম্মান ও নিপীড়নের প্রতি।
তিনি বললেন, আমাকে পেটানো সহজ নয়
আমি দুর্বল অথবা তুচ্ছ নই
আমি দাস নই
আমি নিঃশ্ব নই
তারাই বরং চুরি করেছে আমার সম্পদ।
ঘরহীন ছিলাম না আমি
তারাই কেড়ে নিয়েছে আমার ভূমি।
দয়া করে আমাকে দয়া দেখিও না
আমি জানি কীসে আমার সম্মান বাড়ে-কমে।
মহান যিশু, দয়া করে বলো না
মুর্খদের দিকে অন্য গাল পেতে দিতে
যারা নিয়ত চপেটাঘাত করছে আমাদের।
একটা সুযোগ চাই- সেই ঘৃণাটুকু উগড়ে দিতে
ঠিক যতটুকু ঘৃণা তারা করছে আমাদের।
আর ওই মুর্খ যদি আমাকে হত্যাও করে
বলো, কে হবে বিজয়ী?
সে ভাবছে: আমি এমন মানুষ
যার কেউ নেই
না বন্ধু, না পরিবার।
না অনুসারী, না সমর্থক।
সে দেখতে পায় না-ওই বৃত্তটা
যা বিশ্বজুড়ে মানুষদের করে রেখেছে ঐক্যবদ্ধ।
সকল জাত, ধর্ম ও বর্ণ,
ন্যায় বিচার চেয়ে চিৎকার করছে।
যখন আমি বলি আমি ক্ষুধার্ত
আমি বোঝাই আমি ন্যায় বিচার চাই ।
যখন আমি বলি হাত-পা বাধা আমার
যখন আমি বলি আমি অন্ধ
আমি বোঝাই আপোস করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
যদি আমি বলি একজন দেবদূত বসে আছেন
আমার ডান কাঁধে
আমি বোঝাই ‘মৃত্যুদূত’কে,
আমি বোঝাই ‘ছদ্ম ও অকাল মৃত্যু’কে।
সবই হয়েছে যন্ত্রণার কারণ আমার
যা কিছু স্বপ্নে দেখেছিলাম আমি,
আর দেখেছিল আমার লোকেরা।
বিচারক ও জুরি উভয়েই জানেন আমায়।
তারা জানেন কীসে কষ্ট আমার।
তারা জানেন কী আমার ভাবনা
তারা ভাবেন আমি তাদের ‘ভাবনাচোর’।
শুধু এসবই নয়। যদি আমি বলি, দেবদূত
আমি বোঝাই ‘মৃত্যুর দেবদূত’কে।
আমি বোঝাই ‘ছায়ার দেবদূত’কে।
যারা ছায়া ফেলে আমার সকল ভাবনার ওপর।
তারা শক্ত হাতল ধরে
ঝাঁট দিয়ে বিদায় করে আমার চিন্তাগুলো
নিচে, অবশেষে ঝাড়ু পড়ে থাকে
থাকে না শুধু চিন্তাগুলোই আমার।
থাকে শুধু সাপের কামড়ের দাগ আর রক্তপাতের চিহ্ন,
থাকে শুধু বিষক্ততা আর অজস্র অশ্রুর দাগ
আর আমার অনাক্রম্যতা।
একসময় আমার ঘুম ছিল স্বপ্নহীন
একসময় আমার মন ছিল শূন্য;
এখন আমার স্বপ্ন সমৃদ্ধ,
প্রতিটি চিন্তা স্পষ্ট।
এখন আমি দেখতে পাই সেই পথ
যা অন্যেরা গ্রহণ করেছে;
নাম যার ‘স্বাধীনতার পথ’।
আমি চাই তোমরা শোনো ম্যান্ডেলার কথা
শোনো তাঁর জ্ঞানের কথা।
যারা আমায় শুনতে পাচ্ছ, সবাই শোনো তার কথা
যেমন আমি শুনেছি আর ভাবছি।
আবু হাদরা, আমার কথা শোনো!
কবি-লেখক বন্ধুরা আমার কথা শোনো!
আমি জানি তোমরা তাঁকে বুঝতে পারবে।
এই কবিতার একটি মুক্তিপণ নোট আছে
অনেকের রক্ত দিয়ে লেখা এ নোট,
যারা ন্যায়বিচারের জন্য চিৎকার করেছিল।
এটা ম্যান্ডেলার সমুচিত প্রতিশোধ
সবকিছু তিনি বুঝতে শিখেছিলেন
এবং সবার উদ্দেশ্যে তিনি তুলে ধরেছিলেন আঙুল।
এই কবিতায় রয়েছে একটি ধারাল ব্লেড
যা এর হৃৎপিণ্ডের মধ্যে লুকানো,
আর এর ইস্পাত চিরকালের।
সুতরাং শোনো, ও আবু হাদরা!
যদি তুমি শোনো, তাহলে অন্যেরাও শুনবে।
কথা শুনেই মনে হবে ম্যান্ডেলার আহ্বান
তিনি তোদের বলছেন: হাতে অস্ত্র তুলে নেয়ার জন্য।
তোমরা যে গোপন ধারাল ছুরির সন্ধান করছ
তা রয়েছে-এই কবিতারই ভেতর।
এই কবিতাই দেখাবে বিচার ও জুরি
প্রান্ত খণ্ডিত স্বাধীনতা
এই কবিতাই প্রদর্শন করবে প্রসিকিউটর
এবং সেই ফলক, যা হবে চিরস্থায়ী;
কখনো নোয়াবে না মাথা তারা
অথবা করবে না পদচারণা শিকল কিংবা বেড়িতে আবদ্ধ হয়ে।
এই কবিতা হলো একটি আয়না
কবি হাদরাবি, আমাদের জন্য এই আয়না তৈরি করেছি আমি,
এই আয়না আমরা ওপরে ধরে রাখতে পারি
গণ্ডমুর্খদের দেখানোর জন্য-
আত্মপ্রবঞ্চনার খাদ কত গভীর
আর তা থেকে কত মিথ্যের ফুলঝুরি ছুটে;
বিচারক ও জুরিকে দেখার জন্য
বিস্তৃত পৃথিবী কীভাবে নেত্রপাত করবে তার নিজের দিকে;
সেই লোককে কীভাবে দেখাবে,
জাঁতাপীষ্ঠ হয়েও কারা আনন্দে উল্লসিত হয়, হাসি দিয়ে আড়াল করে বেদনা।
কবি হাদরাবি, এই কবিতা পড়ো
আর শুনিয়ে দাও-যারা শুনতে চায়।
তাদের সাহায্য করো মুখে ভাষা তুলে দিয়ে
আমি দিলাম ম্যান্ডেলাকে।
এবং তাদের বলো, আমাদের উদ্দেশ্য শান্তি,
পাসওয়ার্ড ‘ফ্রিডম’;
আমাদের লক্ষ্য,‘সমতা’
আমাদের পথ আলোর পথ।
ম্যান্ডেলা: নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবিরোধী অবিসংবাদিত দক্ষিণ আফ্রিকান নেতা ও প্রেসিডেন্ট (জন্ম ১৮ জুলাই ১৯১৮, মৃত্যু ৯৫ বছর বয়সে ০৫ ডিসেম্বর ২০১৩)। ১৯৬২ সালের ০৫ আগস্ট জেলে অন্তরীণ হন এবং ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ২৭ বছর জেল খেটে মুক্তি পান এই বিশ্বশান্তির অমোঘ বার্তাবাহী। দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তাঁর সময়কাল ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ১৯৯৭ সালে ২৬ মার্চ, বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে তিনি প্রথম ও শেষবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উপলক্ষ্যে।
হাদরাবি: সোমারিয়ার জাতীয় কবি, জীবন্ত
কিংবদন্তী। পুরো নাম: মুহাম্মদ ইব্রাহিম ওয়ারসেম, হাদরাবি।
|
Dr, Martin Orwin |
ইংরেজি অনুবাদ: আক্ষরিক অনুবাদ মার্টিন ওরউইন (Dr Martin Orwin) ও ম্যাক্সাম জেসান আলতু ( Maxamed Xasan 'Alto')
|
David Harsent |
চূড়ান্ত অনুবাদ: ডেভিড হারসেন্ট( David Harsent) কবি ও অনুবাদক। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ০৯। পয়েট্টি
ট্রান্সলেশন সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন দেশের কবিদের কবিতার খসড়া অনুবাদ চূড়ান্ত
হয় তাঁর হাত দিয়ে। ২০০৫ সালে তাঁর লেজিয়ন কাব্যগ্রন্থটি বেস্ট কবিতাসংগ্রহ হিসেবে
‘ফরওয়ার্ড
প্রাইজ’ জিতে এবং হুইটব্রেড ও টিএস ইলিয়ট প্রাইজের সর্টলিস্টে স্থান পায়।
জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪২ সালে ডেভনে। তিনি যখন তাঁর মায়ের গর্ভে তাঁর বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে
চলে যান। আর তাঁর মা চলে যান গাঁয়ে, তাঁর নানার বাড়িতে। ওখানেই বাবার দেখা পাওয়া ছাড়াই তাঁর জীবনের
সাত বছর কেটে যায়। প্রথম জীবনে মি. ডেভিড ভেবেছিলেন একজন ফুটবল খেলোয়ার হবেন। কিন্তু
হয়েছেন কবি। এখন কবিতা লেখা ও অনুবাদকরার পাশাপাশি বিবিসিতে অনুষ্ঠান করেন।
Translated by
Gazi Saiful Islam, Dhaka.
e-mail-gazisaiful@gmail.com